সরওয়ার ই আলম
থেমে নেই জলে ডুবে শিশু মৃত্যু। কালও নেত্রকোনার আটপাড়ার দুটি শিশু ছয় বছরের আমির হামজা আর পাঁচ বছরের সানি পানিতে ডুবে মারা গেছে। ১৬ অক্টোবর দুজন ও ১৫ অক্টোবর জামালপুর, নেত্রকোনা ও লক্ষ্মীপুরের ছয় শিশু পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়। গত দশ দিনে গণমাধ্যমে অন্তত ২০ জন শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যুর খবর বেরিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ১-১৭ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ পানিতে ডোবা; বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৫০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এ ৫০ জনের মধ্যে আবার ৩২ জনই চার বছরের কম বয়সী। বছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ হাজারে। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ পানিতে ডোবা। কিন্তু এসব প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু নিয়ে কারো কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এত শিশুর মৃত্যু সত্বেও বিষয়টি পরিকল্পনা ও নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে অগ্রাধিকার তালিকায় জায়গা করে নিতে পারেনি। ফলে এ নিয়ে কোনো সরকারি উদ্যোগও নেই।
বছর জুড়েই পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, তবে বর্ষা মৌসুম ও বড় উৎসব, পার্বণ এবং পারিবারিক অনুষ্ঠান কিংবা সরকারি ছুটির সময় দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যায়। এ বছর কয়েক দফা বন্যা হয়েছে, বন্যার সময় সমানতালে ঘটেছে অনাকাঙ্ক্ষিত দূঘর্টনা ও মৃত্যু। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে একটি-দুটি করে জলে ডোবার ঘটনা ঘটে, ফলে আমরা এর ব্যাপকতা অনুধাবন করতে পারি না। পাশাপাশি জল যে শিশুর জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তাও উপলব্ধি করতে পারি না ।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সিনার্গোস গণমাধ্যমে প্রকাশিত দূর্ঘটনাজনিত শিশু মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র জুলাই মাসে দেশের সংবাদমাধ্যমে ৭৬০ জন শিশুর মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ৬৫২ জন অর্থাৎ ৮৬ শতাংশ শিশু মারা গেছে পানিতে ডুবে। জুন মাসে ৮১ শতাংশ বা ৪৮৭ জন এবং এর আগের মাসে ১৯২ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।
শিশুদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষার জন্য সরকারের সহায়ক নীতিমালা, আইন ও বিধি-বিধান রয়েছে। শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা, নিপীড়ন ও শিশুমৃত্যুরোধে দেশে সরকারি, বেসরকারি ও এনজিওদের উদ্যোগে উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। সেসব উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে শিশু উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ভালো। আমরা শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পেরেছি। গর্ভবতী ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা বাড়ির দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ায় ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা বিস্তৃত করার ফলে প্রসবকালীন মা ও শিশু মৃত্যু কমানো গেছে। গুটিবসন্ত, হাম, পোলিও বিদায় করা গেছে টিকাদান কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে। সরকার প্রশংসিত হয়েছে। এর স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু আমাদের শিশুরা পানিতে ডুবে মরছে। কেউ মরছে নির্যাতনের শিকার হয়ে , কেউ মরছে ধর্ষিত হয়ে, কেউবা রাস্তায় গাড়িচাপা পড়ে। বলা চলে- শিশুদের জীবনটা বেশ সস্তাই এদেশে।
কেন ও কোন শিশুরা পানিতে ডুবছে ?
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে খুব বেশি কাজ হয়নি। অজানা কারণে নেতৃস্থানীয় এনজিওগুলো পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে কাজ করতে তেমন আগ্রহী নয়। তবে আশার কথা হলো- অনেক অবহেলিত বিষয়ের মতো পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধেও এগিয়ে এসেছে কেউ কেউ। এরকম প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন সুপরিচিত নয়। তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান সিআরপিআরবি। আন্তর্জাতিক সংস্থা ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রোপিক ও যুক্তরাজ্যের রয়েল লাইফবোট এর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি ২০০৫ সাল থেকে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে কার্যকর স্থানীয় ব্যবস্থা উন্নয়নে কাজ করে আসছে। সিআরপিআরবি তাদের অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক মতামতের ভিত্তিতে বলেছে, দারিদ্র্য, অসচেতনতা ও প্রতিষ্ঠানিক উদ্যোগহীনতার কারণে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে। বাংলাদেশে শিশুরা পানিতে ডুবছে বাড়ির ২০ গজের মধ্যে এবং মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটছে মূলত সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে। এ সময়ে মা-বাবা, বড় ভাইবোন ও পরিচর্যাকারীরা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। মানে সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থেই গ্রামাঞ্চলের শিশুরা অরক্ষিত থাকে। এছাড়াও উদ্বেগের বিষয় হলো বাড়ির পাশের ডোবা-নালা-পুকুর-খাল-বিল সব কিছু উন্মুক্ত। কোনো বেড়া বা দেয়াল নেই। শিশুরা অন্যদের অলক্ষ্যে অবাধে জলাশয়ে চলে যায় এবং দুর্ঘটনার শিকার হয়।
করণীয় কী
বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা ২০১৭ সালে Preventing drowning: an implementation guide এ নির্দেশনা দিয়েছে, এতে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে ডে-কেয়ার সেন্টারের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও নীতি পর্যালোচনা ও দেশীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেওয়ার কথাও রয়েছে। সমাধানটা আসলে জানা। ভারত, ভিয়েতনামসহ অনেক দেশেই কমিউনিটি ও স্থানীয় সরকারকে যুক্ত করে গৃহীত কার্যক্রম সফল হয়েছে। আমাদের দেশে সিআরপিআরবির কমিউনিটি ডে-কেয়ার মডেল ’ভাসা ও সলিড’ এক্ষেত্রে সাফল্য এনেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত আইসিডিডিআরবি, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ও সিআরপিআরবির যৌথ জরিপে পাওয়া তথ্য বলছে এ মডেল বাস্তবায়ন করে বছরে ৮ হাজার শিশুর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। প্রয়োজন কার্যকর উদ্যোগ, আন্তঃমন্ত্রনালয় সমন্ময় ও প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করা।