রূপকথাদের ছুটি

বাসন্তি সাহা

অফিস আর ঘরের কাজ শেষ করতে করতে আমার একফালি বিকেল সন্ধ্যেতে ডুবে যায়। রাতে বিছানায় শুয়ে বাবি-তিস্তার সাথে গল্প করতে করতে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। তিস্তার প্রশ্নে চমকে চমকে উঠি! মা ছোটবেলা ভয় করতো কেন? ভূতের ভয়? ভূত বলে কিছূ আছি নাকি?
আমি বলি- তাহলে তুমি ভয় পাও কেন?
আমার মনে হয় ইনভিজিবিল কিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্ধকারে।
ওইতো একই হল।
তোমাদের ভূত তো ইলিশমাছ পছন্দ করতো। ইনভিজিবলরা কিছু খায় না।
তিস্তা বলে মা, পড়ার বই পড়তে ভালো লাগে না, কারণ আমি ওগুলো ভিজুয়ালাইজ করতে পারি না। বোরিং। না-পড়ার কত যে অজুহাত! ইউটিউবে দেখা ঝলমলে জগত ক্রমশ পেছনে ফেলে দিচ্ছে ছাপার অক্ষরের রূপকথাকে। এই লকডাউনের সময়ে পুরোপুরি অনলাইনকেন্দ্রিক হয়ে গেছে বাচ্চাদের জীবনও। অলনাইনে লেখাপড়া গান গাওয়া সবই চলছে। এমনিতেই বই পড়তে চায় না এখনকার বাচ্চারা । এখন কেবল অনলাইন, ইউটিউব। লকডাউনের এই ক্ষতিও কম নয়।
মেঘের মধ্যে মা গো, যারা থাকে
তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে।
বলে, “আমরা কেবল করি খেলা,
সকাল থেকে দুপুর সন্ধেবেলা।
আমি বলি, “যাব কেমন করে।’
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তিস্তার কথা শুনে ভাবতে চেষ্টা করলাম আমাদের পঙ্খীরাজ ঘোাড়ায় চেপে আসা ডালিমকুমারের কথা। সুঁচরাজা আর কাজলরেখার দুঃখে কাঁদার কথা। কী বোকা ছিলাম আমরা! কুমার বাড়িতে গিয়ে দেখে এসেছিলাম এঁটেল মাটি । পা দিয়ে চেপে চেপে কীভাবে সেই মাটি মাখনের মতো নরম করা হয়। চাকায় ঘুরতে ঘুরতে তৈরি হয় কলসী। কী সুন্দর! কামারের হাপরের কমলা-রঙা আগুনে পুড়ে দা-বটি তৈরি হয়। কীভাবে পাটি বোনা হয়, কীভাবে গামছা বোনা হয় তাঁতে। পড়ার বই আর চারপাশ দেখে আমরাতো ভিজুয়ালাইজ করতে পারতাম সবকিছু।
কুমোর-পাড়ার গোরুর গাড়ি —
বোঝাই-করা কলসি-হাঁড়ি।
গাড়ি চালায় বংশীবদন,
সঙ্গে যে যায় ভাগ্নে মদন।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এখন তিস্তা বলে দেয়, মা কী বল! পঙ্খীরাজ ঘোড়া বলে কিছু হয় না। আর তোমরা অসুরের কথা বল। সে সারা ওয়ার্ল্ড ক্যপচার করেছিল? ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশে, হতে পারে চায়না, আ্যামেরিকাও। আমার বিশ্বাস হয় না! অসুর কখন আসল? হাজার হাজার বছর আগে। এটা কোনো কথা হলো! নিয়ান্ডারথাল মানবের আগে না পরে? ‘‘আর এলেম আমি কোথা থেকে’’?? বাবি দেখতে একদম বাবার মতো কেন?? প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত, হয়রান।
কাল বললাম চুলটা কম্বিং কর তাহলে তাড়াতাড়ি বড় হবে। কেন? চুলে ব্লাড সাকুর্লেশন হবে। এই মরেছে! মা চুলের বাইরের অংশটা মৃত। তাই কাটলে আমরা ব্যথা পাই না। বল যে স্কালপে ব্লাড সার্কুলেশন বাড়বে। তারপর থেকে কম্বিং চলছে।
অন্ধ কানাই পথের ‘পরে
গান শুনিয়ে ভিক্ষে করে।
পাড়ার ছেলে স্নানের ঘাটে
জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটে।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আরও কত কী শিখছি মেয়ের কাছে। ক্রাশ কী! আমি বুঝতে না পারায় বিরক্ত হয়ে বলল, পছন্দ আর ভালোবাসার পার্থক্য বোঝ? না কি তাও বোঝ না। তবে তার কথা শুনে যা বুঝলাম ‘ক্রাশ’ পছন্দ ও ভালোবাসার মাঝামাঝি কিছু একটা। একটা ছেলে-মেয়ে যখন নিজেরা আলাদা সময় কাটায় সেটা হচ্ছে লাভ। আর সবাই মিলে সময় কাটালে সেটা বন্ধুত্ব।
সত্যি এ সহজ বিষয়টা আমরা কেন বুঝতে পারি না!
নতুন-স্বাভাবিকে আমরা অনেককিছু নিজের করে নিয়েছি। হয়তো আগামী কয়েক বছর এভাবেই যাবে। অনলাইনে বাজার, কেনাকাটা আর অনলাইন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিছুদিন আগে বড়বোন বলল, তার মেয়ে ও তার বন্ধুরা জুমে ঝগড়া করে। গীতা পাঠে কথা আগেই শুনেছি। এগুলো ভালো না মন্দ জানি না তবে রোদে-গরমে বাইরে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে।
অন্য সবার কথা জানি না। আমার ঘরে থাকতে ভালো লাগে না। আড্ডা, বাইরের ধুলো, জ্যাম আর রিকশার টুং টাং, বন্ধুদের ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরা আমি খুব মিস করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.