বাসস : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক মুক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক করে দিয়ে সকল বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে আরো এগিয়ে নিতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “স্বাধীনতার ৫৪তম দিবসে আসুন, সকল কুট-কৌশল-ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাই। ”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘স্বাধীনতা দিবস’ এবং ‘জাতীয় দিবস-২০২৪’ এর প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক টেলিভিশন ভাষণে একথা বলেন।
ভাষণটি আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, রেডিও স্টেশন এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে একযোগে সম্প্রচার করা হয়।
তাঁর ১৭ মিনিটের কিছু বেশি সময়ের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ১৫ বছরে তাঁর সরকার কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প, দারিদ্র্য বিমোচন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসসহ দেশের আর্থ-সামাজিক খাতে অভূতপূর্ব এবং দৃশ্যমান উন্নয়ন করে বাংলাদেশকে ‘উদীয়মান অর্থনীতির দেশে’ রূপান্তরিত করেছে।
“সুতরাং, এক সময়ের দারিদ্র্য-জ্বরাক্লিষ্ট বাংলাদেশ আজ সক্ষম উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে,” বলেন তিনি ।
‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব মঞ্চে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে,’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সকল শর্ত পূরণ করেছে। আশা করা হচ্ছে ২০২৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশ স্থায়ীভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হবে।
তিনি বলেন, “আজকে ২০২৪ সালে স্বাধীনতার ৫৩তম বার্ষিকীতে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, আমরা দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেকাংশেই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি। এটা কোন অসার বাগাড়ম্বর দাবি নয়। বাংলাদেশ আজ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল বিশ্বে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমরা প্রমাণ করেছি রাজনৈতিক সদ্বিচ্ছা এবং সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সীমিত সম্পদ দিয়েও একটি দেশকে এগিয়ে নেওয়া যায়।”
‘১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ একুশ বছরের ইতিহাস এদেশের মানুষের নিপীড়ন আর বঞ্চনার ইতিহাস,’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ সময় লুটপাট, দুর্নীতি, ইতিহাস বিকৃতি, মৌলবাদ এবং জঙ্গিবাদ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চেতনাকে ধূলিস্যাৎ করে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর এবং পশ্চাদপদ দেশের তকমা পড়িয়ে দেওয়া হয়। নিদারুণ দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অকাল মৃত্যু এবং শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসার অভাব ছিল এদেশের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। তথাপি ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে জনবান্ধব নীতি গ্রহণ করা শুরু করে এবং সর্বপ্রথম সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন তাঁদেরও সরকারি সেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
তিনি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে বিগত ১৫ বছরের কিছু অধিকসময়ের দেশপরিচালনাকালে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ, মহামারি, যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং সর্বোপরি দেশি-বিদেশি শক্তির নানা ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে শুধু আমাদের দেশের নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল। সে ধকল কাটতে না কাটতেই ২০২২ সালের গোড়ার দিকে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক অবরোধ-পাল্টা অবরোধ আরোপের ফলে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলি চরম সঙ্কটের মুখে পড়েছে। নিত্যপণ্যের উৎপাদন ও বিপণন যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি এসব পণ্যের স্বাভাবিক চলাচলও বাধাগ্রস্ত হওয়ায় পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরসঙ্গে গত বছরের শেষে যুক্ত হয়েছে গাজায় ফিলিস্তিনের উপর ইসরাইলী বাহিনীর গণহত্যা।
২০১৩-১৪ সময়ে এবং ২০১৬ সালে বিএনপি-জামাতের দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধ, অগ্নি-সন্ত্রাস, অগণিত মানুষ হত্যার মত নৃশংসতাকে মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ আখ্যায়িত করে সরকার প্রধান বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি এবং তার মিত্ররা এবারও হরতাল-অবরোধ, অগ্নি সংযোগের মত সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সূচনা করেছিল। কিন্তু জনগণের প্রতিরোধের মুখে এবার তারা পিছু হটতে বাধ্য হতে হয়। তবুও তাদের হাতে বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান এবং কয়েক ’শ কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় নানা প্রতিক’লতা অতিক্রম করেও দেশকে আর্থসামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেওয়ায় তাঁর সরকারের সাফল্যের খন্ডচিত্র ও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৪১.৫ শতাংশ হতে হ্রাস পেয়ে এখন দাঁড়িয়েছে ১৮.৭ শতাংশে এবং হতদরিদ্রের হার ২৫.১ হতে ৫.৬ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। আজ খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ং-সম্পূর্ণ। বর্তমানে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ কোটি ৯৩ লাখ মেট্রিক টন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মাসেতু, ঢাকায় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল, বিভাগীয় শহরগুলির সঙ্গে চার বা তারও বেশি লেনের মহাসড়ক চালু, ইত্যাদি অবকাঠামো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। দেশের শতভাগ এলাকা বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে।
চলমান রমজানে বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সাধারণ জনগণের কল্যাণে তাঁর সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, রমজান মাসের শুরু হতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য রাজধানী ঢাকার অন্তত ২৫টি স্থানে ট্রাকে করে মাছ, মাংস, ডিম এবং দুধ সুলভমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, টিসিবি প্রথম পর্যায়ে সারাদেশের ১ কোটি কার্ডধারী পরিবারের জন্য সুলভমূল্যে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, চিনি এবং ছোলা – এই ৫টি পণ্য বিতরণ করেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ঢাকা ও আশেপাশের এলাকার কার্ডধারী পরিবারের জন্য চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলা ও খেজুর – এই ৬টি পণ্য বিতরণ করছে। ঈদ উপলক্ষে সারাদেশের ১ কোটি ৬২ হাজার ৮০০ পরিবারের জন্য সরকার এক লাখ ৬২৮ মেট্রিক টন চালের বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছে। প্রতি পরিবার বিনামূল্যে ১০ কেজি করে চাল পাবেন।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি এ সম্পর্কে আরও বলেন, আমরা এ বছর সরকারিভাবে এবং দলগতভাবে ইফতার পার্টির আয়োজন নিরুৎসাহিত করেছি। আওয়ামী লীগ এবং এর সকল সহযোগী সংগঠন নির্দেশমত তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত গরিব-দুস্থদের মধ্যে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করছে।
রমজান মাসের শুরুতে খেজুর, আমদানি করা ফল, লেবু, তরমুজ, পেঁয়াজসহ কয়েকটি পণ্যের দাম কিছুটা চড়া ছিল। তবে এসব পণ্যের দাম কয়েকদিনের মধ্যেই স্বাভাবিক ও সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
“জিনিসপত্রের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট হয়। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি মানুষের কষ্ট লাঘবের,” যোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহবান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও পঁচাত্তরের ঘাতক এবং তাদের দোসররা এখনও তৎপর রয়েছে পরাজয়ের বদলা নিতে। সুযোগ পেলেই তারা আঘাত হানবে। তাদের সামনে একমাত্র বাধা আওয়ামী লীগ। হাজারও শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্র বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কখনই ভুলুণ্ঠিত হতে দেবে না। আওয়ামী লীগকে ছলে-বলে-কৌশলে নিচিহ্ন বা দুর্বল করতে পারলেই পরাজিত শক্তির উত্থান অনিবার্য। কাজেই কাণ্ডারি হুঁশিয়ার।
তিনি বলেন, বাঙালি বীরের জাতি। যুদ্ধ করে আমরা এদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় – জাতির পিতা নির্দেশিত এই বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করেই আমরা দেশ পরিচালনা করি। আমাদের কোন প্রভু নেই, আছে বন্ধু। তাই কারও রক্তচক্ষু বাঙালি জাতি কোনদিন মেনে নেবে না। প্রয়োজন হলে বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-সম্মান রক্ষা করবে।
দেশবাসীর উদ্দেশে জাতির পিতার কন্যা বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাদের উপর আবারও আস্থা রাখার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার সব সময়ই সংবিধানকে সমুন্নত রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে এবং জাতীয় সংসদকে রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।
তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য দেশের যে উন্নয়ন সাধন করেছি তা থেকে থেকে দেশকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। যে বাংলাদেশ হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্য-মুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ।