বরিশাল বিএম কলেজের গাড়ি অচল, টাকা আদায় সচল

বরিশাল থেকে এম.মিরাজ হোসাইন: সরকারি বজ্রমোহন (বি.এম) কলেজের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য কলেজের তিনটি বাসের মধ্যে দুটি বাসই গত ৮ বছর ধরে অচল থাকলেও সচল রয়েছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গাড়িসংক্রান্ত খাতের অর্থ আদায়। এ নিয়ে কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

কলেজের অর্থনীতি বিভাগ থেকে চলতি বছর সম্মান পাস করেছেন বানারীপাড়ার দিনমজুর হাসমত আলীর কন্যা ইসরাত জাহান। বাবার অর্থ সংকটের কারণে তার কলেজের কাছাকাছি কোন মেসে থাকা কিংবা প্রতিদিন গাড়ি ভাড়া দিয়ে ক্লাসে আসা সম্ভব হয়নি। কিন্তু গত চার বছরে কলেজের নির্ধারিত সব অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে তাকে। এরমধ্যে চার পরীক্ষার সময় কেবল গাড়ি ক্রয় ও মেরামত বাবদ তাকে দিতে হয়েছে নয়’শ টাকা। কিন্তু কলেজের গাড়ি তিনি কখনো চোখেও দেখেননি। কলেজের বানারীপাড়া রুটের গাড়িটি গত এক যুগ ধরে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ রয়েছে।

সম্মান শেষ বর্ষের ফরম পূরণের জন্য এক হাজার টাকার বন্দোবস্ত করতে এক মাস অন্যের দোকানে কাজ করতে হয়েছিল বিএম কলেজের ইংরেজী বিভাগের ছাত্র অভিজিত কর্মকারকে। সম্মানে ভালো ফলাফলও করেছেন তিনি। অভিজিত জানালেন, চার বছরে কোনো দিনই তাদের গৌরনদী রুটে বিএম কলেজের গাড়িটিকে চলাচল করতে দেখেননি। ৮ বছর ধরে ওই রুটের কলেজের গাড়িটি বন্ধ রয়েছে। অথচ গাড়ি ক্রয় ও মেরামত বাবদ তাকেও চার পরীক্ষার সময় কলেজ প্রশাসনকে দিতে হয়েছে নয়’শ টাকা। শুধু ইসরাত জাহান কিংবা অভিজিতই নন; ২০০৮ সাল থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ভর্তির সময় গাড়ি ক্রয় বাবদ ১০০ টাকা করে দিতে হয়েছে। এছাড়া ফরম পূরণসহ বিভিন্ন সময় একই খাতে প্রায় কোটি টাকা উত্তোলন করা হলেও কোন শিক্ষার্থীরাই গাড়ির চেহারা দেখারও সুযোগ পাননি।

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ভর্তির সময় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে গাড়িসংক্রান্ত খাতে ১০০ টাকা করে আদায় করায় গত আট বছরে ভর্তি হওয়া ৩৬ হাজার শিক্ষার্থীর (প্রতিবছর ভর্তির নির্ধারিত কোটা সাড়ে চার হাজার) কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা। অন্যদিকে পাস করে যাওয়া গত দুই ব্যাচের সাত হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে একই খাতে (প্রতি বছর ২০০ টাকা করে চার বছরে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৮০০ টাকা) আরো ৫৬ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে। এছাড়া একই খাতে সম্মান প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত (পরীক্ষার্থী) চার হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আট লাখ টাকা (ফরম পূরণের সময়), দ্বিতীয় বর্ষের চার হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকা (প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষার সময় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ২০০ করে ৪০০ টাকা), তৃতীয় বর্ষের চার হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ২৪ লাখ টাকা (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার সময় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ২০০ করে ৬০০ টাকা) আদায় করা হয়েছে। সবমিলিয়ে ২০০৮ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গাড়ি ক্রয় ও মেরামত বাবদ ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা আদায় করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ১৯৯৫ সালের পর কোনো গাড়িই ক্রয় করা হয়নি। এর আগে ক্রয় করা তিনটি গাড়ির মধ্যে দুটি গত এক যুগ ধরে বন্ধ রয়েছে।

কলেজ প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের আগে কলেজের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য দুটি বাস ক্রয় করা হয়। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস একটি বাস উপহার দিয়েছিলেন। এরপর আর কোনো বাস ক্রয় করা হয়নি। ওই বাস তিনটি কলেজ থেকে বানারীপাড়া ও গৌরনদী উপজেলা এবং ঝালকাঠী জেলায় শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু ২০০৮ সালে বানারীপাড়া ও গৌরনদী উপজেলায় চলাচল করা বাস দুটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। একাধিকবার সংস্কার করার পরেও ওই বাস দুুটি আর ব্যবহারে উপযোগী হয়ে ওঠেনি। বি.এম. কলেজের পরিবহন ক্রয় ও মেরামত কমিটির আহবায়ক গোলাম মোর্শেদ বলেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উত্তোলনকৃত টাকা দিয়ে তিনটি বাস প্রায়ই মেরামত করা হয়েছে। মেরামতে ১০ লাখ টাকার ওপর খরচও হয়েছে। তার পরেও দুটি বাস যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দীর্ঘ সময় ধরে অচল রয়েছে। এ কারণে ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন একটি বাস কলেজের জন্য ক্রয় করা হয়েছে। খুবশীঘ্রই বাসটি কলেজে আনা হবে। কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফজলুল হক বলেন, গাড়ি ক্রয় ও মেরামত বাবদ উত্তোলনকৃত সব অর্থই কলেজের হিসাবে জমা করা হয়। পরিবহন কমিটি গাড়ি মেরামতে এ অর্থ ব্যয় করে। দুটি গাড়ি বন্ধ থাকার কথা স্বীকার করে তিনি আরো বলেন, নতুন একটি গাড়ি ক্রয় করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে আরো গাড়ি ক্রয় করা হবে।