ডাক্তার না হয়েও কোটি টাকার চিকিৎসাবাণিজ্য, কলাপাড়ায় সার্টিফিকেট চেয়ে ৩ জনকে নোটিশ

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী): ডাক্তারি পাশ না করেও দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া পদবি ব্যবহার করে কলাপাড়ার বিভিন্ন ক্লিনিকে বসে চিকিৎসাবাণিজ্য চালিয়ে কোটিপতি বনে গেছেন তিনজন কথিত ডাক্তার। তাদের কারোরই ডাক্তারি পাশের সনদ নেই। বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এর নিবন্ধনও নেই তাদের।

চিকিৎসা সনদ ও বিএমডিসির নিবন্ধন ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে কলাপাড়া শহরসহ গ্রামাঞ্চলে মাইকিং করে নিজেদের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পরিচয় দিয়ে চিকিৎসার নামে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন তারা। সংশ্লিষ্ট ক্লিনিক মালিকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা আর পটুয়াখালী জেলা ও কলাপাড়া উপজেলার স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক এবং বর্তমান কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশেষ ‘সখ্যতা’ বজায় রেখে নির্বিঘ্নে রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন এই তিন চিকিৎসক।

kalapara fake doctorsগত একমাস ধরে এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে এরকম চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানের পর স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ তৎপর হয়েছে। প্রতারক ডাক্তারদের চিকিৎসা সনদ ও বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন নম্বর চেয়ে তিন ডাক্তারকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে ৩০ আগস্ট কলাপাড়া হাসপাতালের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা  ডা. মোহাম্মদ লোকমান হাকিম এই নোটিশ প্রদান করেন। ২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়।

অভিযুক্ত ডাক্তাররা হলেন কলাপাড়ার লাইফ কেয়ার ডায়গনস্টিক ল্যাব-২ চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী ডা. মো. মনির হোসেন, পপুলার ডায়গনস্টিক ল্যাবে চিকিৎসা প্রদানকারী ডা. মোহাম্মাদ শরিফ জালাল ও পায়রা মেডিকেল হলে চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী ডা. তৌফিকা জেরিন হক।

অনুসন্ধানে জানা, এ প্রতারক ডাক্তাররা যে ক্লিনিকে বসে রোগী দেখতো ওই ক্লিনিক মালিক ও ডাক্তারের সাথে গোপন চুক্তি থাকতো। ডাক্তারের রোগী দেখার সকল আয়োজন করতো ক্লিনিক মালিক। বিনিময়ে রোগীদের সামান্য রোগ হলেও একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফর্দ ধরিয়ে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতো টাকা। এ টেস্টের টাকার শতকরা ৩০/৪০ ভাগ পেতো ওই ডাক্তার, বাকিটা ক্লিনিক মালিকের।

গত এক মাস ধরে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই ডাক্তাররা প্রতিদিন গড়ে ৩৫/৫০ জন রোগী দেখতো। প্রতি রোগীর কাছ থেকে তিন শ থেকে চার শ টাকা ভিজিট আদায় করতো। সাথে টেস্ট করানোর কমিশন। সেই  হিসাবে একেকজন প্রতিদিন ২০/২৫ হাজার টাকা আয় করতেন। এভাবে তারা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন শুধু ভুয়া ব্যবস্থাপত্র লিখেই।

ডা. মনির তার ছাপানো ব্যবস্থাপত্রে নিজেকে ঢাকার হলিহোম হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ও নাইটিঙ্গেল মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন প্রভাষক উল্লেখ করেন। তিনি নিজেকে মেডিসিন, হৃদরোগ, লিভার ও ডায়াবেটিস, পরিপাকতন্ত্র চিকিৎসায় অভিজ্ঞ বলে উল্লেখ করেছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিনি ২০০৫ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে একটি সার্টিফেকট কোর্স করেছেন। তবে সেটি এমবিবিএস কোর্স নয়। প্রায় ছয় বছর ধরে তিনি কলাপাড়ায় একাধিক ক্লিনিকে নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে দু শ থেকে চার শ টাকা ভিজিট নিয়ে রোগী দেখছেন। তার চিকিৎসায় শতশত মানুষের রোগের জটিলতা বেড়েছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ ।

ডা. মোহাম্মাদ শরিফ জালালও তার ব্যবস্থাপত্রে নিজেকে মেডিসিন, প্যারালাইসিস, বাতজ্বর ও ব্যথা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও চর্ম-যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেছেন। তার পদবিতে উল্লেখ রয়েছে- এমবিবিএস ঢাকা, পি.জি.টি, এফসিপিএস, মেডিসিন পার্ট-২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। কিন্তু তিনিও তার চিকিৎসা সনদ ও বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন দেখাতে পারেননি।

ডা. তৌফিকা জেরিন হক ২০১০ সালে খুলনার হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছেন বলে দাবি করেন। তার ব্যবস্থাপত্রে নিজেকে ডিএমএফ (ঢাকা), ডিএইচএমএস (ঢাকা), মা ও শিশু এবং গাইনি বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উল্লেখ করেছেন।

নিজেদের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। এতে রোগীরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসব ডাক্তার যে ক্লিনিকে বসে রোগী দেখেন ওই ক্লিনিক মালিকের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেন। ডাক্তারের রোগী দেখার সকল আয়োজন করতেন ক্লিনিক মালিক। বিনিময়ে রোগীদের সামান্য রোগ হলেও একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফর্দ ধরিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতেন। এসব টেস্টের টাকার শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ পান সংশ্লিষ্ট ডাক্তার। বাকিটা ক্লিনিক মালিকের।

গত এক মাস ধরে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই ডাক্তাররা প্রতিদিন গড়ে ৩৫/৫০ জন রোগী দেখতো। প্রতি রোগীর কাছ থেকে তিন শ থেকে চার শ টাকা ভিজিট আদায় করতো। সাথে টেস্ট করানোর কমিশন। সেই  হিসাবে একেকজন প্রতিদিন ২০/২৫ হাজার টাকা আয় করতেন। এভাবে তারা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন শুধু ভুয়া ব্যবস্থাপত্র লিখেই।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, পটুয়াখালী জেলা ও কলাপাড়া স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা এই তিন ডাক্তারের মেডিকেল সনদ না থাকার বিষয়টি জানলেও বিশেষ ‘সখ্যতার’ কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেননি। বিভিন্ন সময়ে জেলা সিভিল সার্জন বিভিন্ন অবৈধ ক্লিনিকে অভিযান চালালেও এসব ডাক্তারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে বিষয়টি বের হয়ে আসলে তৎপর হয় স্বাস্থ্য বিভাগ।

এ ব্যাপারে ডা. তৌফিকা জেরিন হক বলেন, তিনি হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। তাই সব রোগেরই চিকিৎসা করেন। তার চিকিৎসায় সব রোগীই ভালো হয়েছে দাবি করে বলেন, তিনি এখনো নোটিশ হাতে পাননি। নোটিশ পেলে জবাব দিবেন।

ডা. মো. মনির হোসেন বলেন, তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে পাস করেছেন। তবে তার ব্যবস্থাপত্রে এতো পদবি কেন জানতে চাইলে তিনি ‘আপনার সাথে পরে কথা বলব’ বলে টেলিফোন লাইন কেটে দেন।

ডা. মোহাম্মাদ শরিফ জালাল দাবি করেন, তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর আছে। তবে নম্বরটি তার মনে নেই। তিনি কোন মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছেন তাও জানাতে পারেননি।

কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ লোকমান হাকিম বলেন, কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে তিনি ওই তিন ডাক্তারকে নোটিশ করেছেন। তিন দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে না পারলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, এলাকাবাসীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই তিন ডাক্তারের চিকিৎসা সনদ ও বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন দেখতে চেয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে তিনি নোটিশ করতে বলেছেন।