প্রতিনিধি, বাগেরহাট: সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের পশুর নদীতে ৫১০ টন কয়লা নিয়ে একটি কার্গো ডুবে গেছে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে মংলার জয়মনির ঘোল বউটি মার্কেট এলাকায় পশুর নদীতে কার্গোটি ডুবে যায়। এ ঘটনায় বন বিভাগের পক্ষ হতে মামলা দায়ের হয়েছে এবং তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মামলার আসামি হিসেকে ডুবে যাওয়া কার্গোটির মাস্টার মো. ভুলু গাজীকে পুলিশ আটক করেছে। বুধবার বিকেল পর্যন্ত কার্গো উদ্ধার অভিযান শুরু হয়নি।
কার্গোটিতে কর্মরত ১০ নাবিককে উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ ফাঁড়িতে রাখা হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতে মাস্টার মো. ভুলু গাজী (৪০) জানান, এমভি জি. আর রাজ নামে কার্গোটি ৫১০ টন কয়লা নিয়ে মংলা বন্দরের হারবাড়িয়া থেকে খুলনা যাচ্ছিল। সুন্দরবন সংলগ্ন পশুর নদীতে পৌঁছে কার্গো জাহাজটির তলা ফেটে যায়। দ্রুত জাহাজটিকে তীরে আনার চেষ্টা করা হয়। ধীরে ধীরে তাতে পানি উঠতে শুরু করে। জাহাজটি ডুবে যাচ্ছে বুঝতে পেরে মাস্টার ও নাবিকরা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে তীরে উঠে আসেন। এক পর্যায়ে খাদ্য গুদাম সংলগ্ন জয়মনির ঘোল এলাকায় জাহাজটি ডুবে যায়।
এসব কয়লা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। মংলা বন্দরের হারবার কন্ট্রোল রুমের মো. বারী জানান, ২৫ হাজার ২৭০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি গ্যালভেসটন গত ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম হয়ে মংলা বন্দরে আসে। খালাসের পর কার্গোটিতে করে ওই কয়লা খুলনা পাঠানো হচ্ছিল।
পুর্ব সুন্দরবন বিভাগীয় কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম দুপুরে জানান, ঘটনা তদন্তে বন বিভাগের পক্ষ হতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা আগামী দুই কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিবেন।
মংলা থানর অফিসার্স ইনচার্জ লুৎফর রহমান জানান, প্রাথমিকভাবে ১ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দাবি করে বুধবার দুপুরে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ফরেস্টার মিজানুর রহমান বাদী হয়ে মংলা থানায় মামলা করেছেন। মামলায় ঢাকার সেফ ব্রার্দাস নামের কোম্পানিটির ডুবে যাওয়া এমভি জি. আর রাজ কার্গোর মালিক দিল খানকে ও মাস্টার ভুলু গাজীকে আসামি করা হয়েছে । ভুলু গাজীকে মংলা থানা পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে।
কার্গোর মালিক দিল খানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, বেসরকারি একটি উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে মংলায় কার্গোটি উদ্ধারের ব্যপারে যোগাযোগ হয়েছে তাদের। বৃহস্পতিবার সকালে উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠানটি তাদের সকল সরঞ্জাম নিয়ে মংলায় পৌছাবার কথা। প্রথম পর্যায়ে ডুবে যাওয়া কার্গো থেকে মাল অপসারণ করে পরবর্তীতে কার্গোটি টেনে উঠানো হবে বলে তিনি জানান।
অপরদিকে কার্গোডুবির ঘটনার বিষয়ে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ট্রাফিক পরিচালক কাজী গোলাম মোক্তাদের জানান, জাহাজটি বর্তমানে মূল চ্যানেলের বাইরে নিমজ্জিত থাকায় এই চ্যানেল দিয়ে জাহাজ ও নৌযান চলাচল সম্পূর্ণ ঝুকিমুক্ত রয়েছে। তবে প্রচণ্ড স্রোতের টানে এটি নদীর ভিতরের দিকে গেলে ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
কয়লাবাহী কার্গো দুঘর্টনার প্রভাব নিয়ে জানতে চাইলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন বলেন, কয়লায় কার্বন রয়েছে। বিষাক্ত কয়লায় জলজ প্রাণী ও সুন্দরবন এবং পশুর নদীর প্রাণিবৈচিত্র্য-জীববৈচিত্র্য ক্ষতির আশংকা রয়েছে।
পরিবেশ উন্নয়ন কর্মী মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল জলিল, ফরিদুল আলম ও নূর আলম জানান, সুন্দরবনের মধ্যে কয়লাবোঝাই কার্গো ডুবে যাওয়ার ফলে স্বাভাবিকভাবে নদীতে ছড়িয়ে পড়া কয়লার প্রভাবে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে। তারা বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের মধ্য একের পর এক জাহাজডুবির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বনের মধ্য দিয়ে সকল প্রকার জাহাজ, কার্গো চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধের দাবি জানান।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তারের বলেন, কয়লাবাহী জাহাজডুবি সুন্দরবনের জন্য দীর্ঘ বিষক্রিয়া সৃষ্টি করবে। কয়লার সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন প্রভৃতি সুন্দরবনের পানি, জীবমন্ডল ও বায়ুমন্ডলকে দূষিত করবে। ক্ষতিকর মিথেন গ্যাস সুন্দরবনের শ্বাসমূল উদ্ভিদ ও মাছের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
গত বছর ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের এই রেঞ্জের কাছে শেলা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটারের বেশি ফার্নেস ওয়েলবাহী ট্যাংকার ডুবে যায়। ওই তেল সুন্দরবনের বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এর ক’দিন পরে একটি সারবাহী জাহাজ ডুবে যায়।