রায়পুরের সড়কগুলোর বেহাল দশা, জনদুর্ভোগ চরমে

মো. মাহবুবুল আলম মিন্টু, রায়পুর (লক্ষ্মীপুর): রায়পুরের সড়ক-মহাসড়কগুলো ভেঙেচুরে এখন বেহাল দশা। ছোট-বড় বহু গর্ত তৈরি হয়েছে এসব সড়কে। গর্তের সংখ্যা এতোটাই বেশি যে যান চলাচলের জন্য ৫-১০ হাত ভালো সড়ক খুঁজে পাওয়াও কঠিন। শুধু প্রধান সড়কগুলো নয়, স্থানীয় সড়কগুলোর অবস্থাও খুবই করুণ।

নিম্নমানের সংস্কার কাজ বা দীর্ঘদিন সংস্কারবিহীন পড়ে থাকা, কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকির অভাব, ঠিকাদারদের দফায় দফায় কাজ ‘বিক্রি’, ‘কমিশন’ বাণিজ্যসহ নানা কারণে এসব সড়ক টেকসই হচ্ছে না। আবার অনেক সড়কের জন্য বরাদ্দ চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এসব সড়কে চলাচলকারী যাত্রীদের জীবন হাতে নিয়ে চলতে হয়। এসব রুটে চলাচলকারী যানবাহনের চালকরাও ব্রেক কষতে কষতে বিরক্ত।

Raipur roads
৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হলেও ছয় মাসও টেকেনি রায়পুর-লক্ষ্মীপুর মহাসড়ক।

সড়কগুলোর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে রায়পুর পৌরসভা, এলজিইডি ও সড়ক বিভাগ। এলাকাবাসীর অভিযোগ, নির্মাণ ও মেরামত কাজে ত্রুটি থাকায় সড়ক সংস্কারের দু-তিন মাসের মধ্যেই সেগুলো ভেঙেচুরে যান চলাচলের উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে। আবার মেরামত কাজের সময় সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল বিভাগের যথাযথ তদারকির অভাবকেও দুষছেন এলাকাবাসী।

বিশেষ ‘কমিশন’ বাণিজ্যের কারণেও সড়কের কাজ নিম্নমানের হয় বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ। এছাড়া ঠিকাদারদের টেন্ডার বিক্রির প্রবণতার কারণেও অর্থের বড় ধরনের অপচয় হয়। প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডারে কাজ পেলেও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার কাজ না করে ‘টেন্ডার বিক্রি’ করে সম্পূর্ণ অকারণে অর্থ হাতিয়ে নেন। কিন্তু একবারের মধ্যেই এই কাজ বিক্রি সীমিত থাকে না। একটি কাজ ৫-৬ দফায়ও বিক্রি হয় বলে জানা গেছে। সর্বশেষ যিনি কাজ কিনে নেন তার পক্ষে আর ন্যূনতম মান বজায় রেখে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে।  তিনি কোনোমতে কাজ সেরেই নিজের পাওনা বুঝে নেন। একারণে মোট বরাদ্দের অর্ধেক টাকার কাজও হয় না। অন্যদিকে রয়েছে কমিশন বাণিজ্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঠিকাদার জানান, ভাইরে ঘাটে ঘাটে টাকা দিলে রাস্তার কাজ কীভাবে ভালো হবে ?

কিছু দিন আগে কোটি টাকায় দুটি সড়ক মেরামত করা হলেও সেগুলো অল্পদিনের মধ্যেই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা সূত্রগুলো জানায়, ছয় মাস আগে ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে রায়পুর-লক্ষ্মীপুর সড়কের ১৫ কিলোমিটারের সংস্কার কাজ করা হয়। ওই কাজটি পান কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকার ঠিকাদার ও আওয়ামী লীগ নেতা পাখি। ওই সড়কটির বহু স্থানে এখন গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। অসংখ্য স্থানে পিচ ও পাথর ওঠে গেছে। জুন মাসে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্যা সড়কের দুই কিলোমিটার সংস্কারের ১৮ লাখ টাকার কাজ পান ঠিকাদার ভূঁইয়া কামাল রায়হান। ওই সড়কটিরও বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, দুই মাস আগে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে টিএন্ডটি সড়কটি সংস্কারের কাজ করার কার্যাদেশ দেয়া হয়। দুই দফা হাতবদল হয়ে তৃতীয় ঠিকাদার এক আওয়ামী লীগ নেতা এখনো কাজটি শুরুই করেননি।

গত তিন-চার বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে অনেকগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে এসব সড়কে। হতাহত হয়েছে শতাধিক যাত্রী। অনেকটা মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে এই সড়ক, মহাসড়কগুলো। দেবে যাওয়ার অংশগুলো কয়েকটি স্থান দায়সারাভাবে মেরামত করা হলেও তা কোনো কাজে আসছে না। মেরামতের কয়েকদিন পরই তা আবার দেবে যাচ্ছে।

রায়পুর-হায়দরগঞ্জ সড়কটি এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ১৫ কিলোমিটারের এ সড়কটির প্রায় পুরোটাই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে। উপজেলা পরিষদ থেকে হায়দরগঞ্জ বাজার পর্যন্ত অংশের শোচনীয় অবস্থা। রাস্তার অধিকাংশ স্থান খানাখন্দে ভরা। কোথাও কোথাও সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। এসব গর্তের কোথাও হাঁটু আর কোথায় কোমর পর্যন্ত গভীর। দেখলে মনে হবে যেন ডোবা। প্রায়ই এসব গর্তে পণ্যবাহী ট্রাক, যাত্রীবাহী যানবাহন ও অটোরিকশা দেবে যায়। এই কারণে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ ভোগান্তি। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই অঞ্চলের ফসল সয়াবিন, নারিকেলসহ বিভিন্ন শস্য পরিবহন করছে।

কাপিলাতলি সড়কের কেএসপি উচ্চ বিদ্যালয়ের পিছনের রাস্তায় পুকুরের মতো গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে প্রতিদিন দেবে যাচ্ছে যাত্রীবাহী যানবাহন ও আটোরিকশা এবং পণ্যবাহী ট্রাক। এ সড়ক দিয়ে যাতায়াতের সময় জনপ্রতিনিধিদের এলাকাবাসীর রোষানলে পড়তে হয়। রায়পুর সড়ক থেকে গাজীনগর ও সাবেক এমপি হারুনুর রশিদ সড়কের বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গিয়ে বড় বড় গর্ত ও উঁচু-নিচু থাকায় যানবহন চলাচলে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। মাঝে মধ্যে সড়কগুলো সংস্কারের নামে দায়সারা ভাবে কাজ করা হয়।

রায়পুর-ফরিদগঞ্জ-পানপাড়া সড়কের গর্ত ও ফাটল দেখা দেওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় গত এক বছরে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৩০ জন। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অনেকে, আহত হয়েছেন প্রায় এক হাজারেরও অধিক। সড়ক মহাসড়কের দুরবস্থা দেখা দিলেও কার্যত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, এই সড়কগুলোর মধ্যে সোনাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাটওয়ারীর রাস্তার মাথা, মাইলের মাথা, নতুন বাজার, হাজির তলা, পূবলাছ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে, রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের সামনে, মৈশালবাড়ীর সামনে, মিতালী বাজার, হায়দরগঞ্জ বাজার, কাপিলাতলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে, গাজী নগর বাজার,  রুস্তম আলী ডিগ্রি কলেজের সামনে ও খাসেরহাট বাজারে রাস্তাজুড়ে প্রচুর গর্ত ও ফাটল দেখা দিয়েছে। কয়েকটি স্থানে ইট ও বালু দিয়ে কিছু কিছু গর্ত ভরাট করা হলেও তা খুব একটা কাজে আসছে না।

দেবীপুর গ্রামের সমাজ সেবক মাহবুব আলম চৌধুরী ও প্রধান শিক্ষক হাবিব আহম্মেদ পাটওযারী সাংবাদিকদের বলেন, এই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবনের ঝুকি নিয়ে চলাচল করছে। সড়কটি মেরামতের জন্য এমপি ও চেয়ারম্যানকে বললেও তারা কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। অটোরিকশাচালক ইব্রাহীম বলেন, প্রতিদিন মানুষ এই সড়ক দিয়ে পারাপার হতে ঠিকাদার ও চেয়ারম্যানদের ভোড়-চৈতাল (গালাগাল) বলে। আর দুদিন পর পর গাড়ির একটা একটা পার্টস ভেঙে যায়। পরিবহন চালকরা এ নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ।

রায়পুর পৌরসভার মেয়র এবিএম জিলানী ও নির্বাহী প্রকৌশলী এটিএম সাদেক সাংবাদিকদের বলেন, পৌরসভার সড়কগুলো সংস্কারের জন্য কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। সংস্কার কাজে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে সে কাজগুলো স্থগিত রাখা হয়েছে। অন্য সড়কগুলো দ্রুত করার জন্য চেষ্টা হচ্ছে।

এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী আক্তার হোসেন ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, কোনো বরাদ্দ না পাওয়ায় সড়কগুলো মেরামত বা সংস্কার কাজ করা যাচ্ছে না। এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যানরা সড়কের বিষয়ে জানালেও কিছুই করা যাচ্ছে না। তারপরও হায়দরগঞ্জ সড়কটি ইট-বালু দিয়ে সাময়িক মেরামত করে দেয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.