মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী): কলাপাড়ার মিঠাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণির ১৫-২০ জন ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় অভিযুক্ত বিএনপি নেতা জাফর ফরাজীর (৪৫) শাস্তির দাবিতে শহরে এসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ওই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। আজ নির্যাতনকারীর শাস্তি চেয়ে দূর গ্রাম থেকে আসা শতাধিক শিশুর আকস্মিক বিক্ষোভ মিছিলে কেঁপে উঠে কলাপাড়া শহর। শিশুদের সঙ্গে অভিভাবক ও শিক্ষকরাও যোগ দেন এই মিছিলে।

কলাপাড়া পৌর শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে আন্ধারমানিক নদী সংলগ্ন মিঠাগঞ্জ সরকারি বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা গত দু’দিন ধরে শিশু যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদে ক্লাস বর্জন করে মিঠাগঞ্জ ইউনিয়ন এক নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাফর ফরাজীর শাস্তির দাবিতে লাগাতার আন্দোলন করছে। কিন্তু অভিযুক্ত বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় রোববার কলাপাড়া পৌর শহরে এসে বিক্ষোভ মিছিল, প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে নিপীড়নের শিকার ছাত্রীর পক্ষে বিচার চায়।
জানা যায়, ওই বিদ্যালয়ের সামনে বিএনপি নেতা জাফর ফরাজীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বিদ্যালয়ের ছুটির সময়ে ছাত্রছাত্রীরা ওই দোকান থেকে বিস্কুট, চকলেটসহ বিভিন্ন খাবার সামগ্রী কিনে খেত। দোকানে ছাত্রীরা গেলে ওই বিএনপি নেতা তাদের কোলে নিয়ে, দোকানে উঠিয়ে বিভিন্ন সময় শারীরিক নিপীড়ন করতো। গত এক মাসে একাধিক ছাত্রীর সাথে এ অশোভন আচরণ করায় তারা তাদের অভিভাবকদের নালিশ করে। এই ঘটনায় তারা বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে । একে একে বেরিয়ে আসে একাধিক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের তথ্য। বিক্ষুদ্ধ অভিভাবকরা বিষয়টি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটিকে লিখিতভাবে অবহিত করলেও তারা কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় ক্লাসবর্জন করে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। খবর পেয়ে রাতে এলাকা ছেড়ে জাফর ফরাজী পালানোর সময় এলাকাবাসী দুইদিন আগে তাকে ধরে গণধোলাই দেয়। কিন্তু বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় রোববার পৌর শহরে এসে বিচারের দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা।
রোববার সকালে প্রায় শতাধিক ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরা কর্দমাক্ত রাস্তা পার হয়ে স্কুলের সামনে আসেন। সেখান থেকে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ট্রলারে করে পৌর শহরে এসেই শুরু করে বিক্ষোভ মিছিল। শিশুদের আকস্মিক এই মিছিলে রাস্তার দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। সবার মুখে শ্লোগান “শিশু নির্যাতনের বিচার চাই, জাফর ফরাজীর শাস্তি চাই”। শিশুদের এ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে শহরের বিভিন্ন পেশার মানুষও তাদের এই আন্দোলনে যোগ দেয়। প্রায় দেঢ় ঘন্টাব্যাপী মিছিল ও মানববন্ধন শেষে তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে নির্যাতনের শিকার ছাত্রীদের পরিচয় জানিয়ে শাস্তির জাফর ফরাজীর শাস্তি দাবি করে।
আন্দোলনকারী পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়,“চাচার দোহানে (জাফর ফরাজী) কিছু কেনতে গ্যালেই চাচায় মাইয়াগো কোলে লয়। গাল টেপে, চুমা দেয়। আরো অনেক জায়গায় (স্পর্শকাতর স্থানে) হাত দেয়। অনেক মাইয়াগো দোকানের পিছনেও নেছে। তাই চাচার বিচার না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।”
নিপীড়নের শিকার একাধিক স্কুল ছাত্রীর অভিভাবক বলেন, আমরা না ঠ্যাকলে ১০-১৫ মাইল হাইট্যা, ট্রলারে কইর্যা নদী পাড়াইয়া কলাপাড়া আসতাম না। ছোড ছোড মাইয়াগো লগে বুড়া ব্যাডায় যা করছে তা কওয়াও যায় না। অনেকদিন ধইর্যাই এই কাজ করতাছে বুড়াডায়। সর্বশেষ এক প্রতিবন্ধী মাইয়ার লগেও খারাপ আচরণ করে। ওই মাইয়ায় না কইলে তো এইডা কেউ জানতোই না। আমরা এইয়ার বিচার চাই।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গাজী মো. জহিরুল ইসলাম জানান, ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের নিয়ে কলাপাড়া উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা মো.আরিফুর রহমান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর কাছে গেলে তাদের নির্দেশে তিনি কলাপাড়া থানায় জাফর ফরাজীকে প্রধান আসামি করে অভিযোগ দাখিল করেছেন।
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সাহিদা বেগম জানান, কোমলমতি ছাত্রীদের সাথে এরকম আচরণ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারনেনি তিনি। তাই ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের আন্দোলনের সাথে তারা সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন।
এ ব্যাপারে বিএনপি নেতা জাফর ফরাজী জানান, তাকে সমাজে হেয় করার জন্য একটি চক্র এই আন্দোলন করছেন। তিনি কোনো ছাত্রীর সাথেই অশোভন আচরণ করেননি।
উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আরিফুর রহমান জানান, এ অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে আর সামনে না ঘটে এজন্য আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কাল থেকে আবার নিয়মিত ক্লাস শুরু হবে।