প্রতিনিধি, বাগেরহাট: সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের শনিবার রাত থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত ঝড়ে নিখোঁজ জেলেদের পরিবারে কান্নার রোল চলছে। ঝড়ে বাগেরহাট ও বরগুনার কমপক্ষে ১২টি মাছ ধরার ট্রলার ডুবে যায়। ট্রলারডুবির ঘটনায় আজ সোমবার সকাল পর্যন্ত অন্তত ২৫ জেলে নিখোঁজ রয়েছেন।
সোমবার দুপুর পর্যন্ত নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড ১০১ জন জেলেকে উদ্ধার করেছে। সাগরে ভাসমান অবস্থায় তাদের উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধারকৃতদের সিসিএমসি (কোস্ট গার্ড ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার), দুবলারচর, কচিখালী ও সুপতী কোস্ট গার্ড স্টেশনে নেযয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে বলে মংলা কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী মাসুদ জানিয়েছেন। উদ্ধারকৃতদের বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারী, কচুয়ার বগা-ভাষা, শরনখোলা, মোড়েলগঞ্জ, বরগুনা ও পিরোজপুরের বিভিন্ন এলাকায়। এখনো সমন্বিতভাবে উদ্ধার অভিযান চলছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে নিখোঁজদের ব্যাপারে তিনি কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
ঝড়ের কবলে পড়া এখনো অসংখ্য ট্রলার সাগর ও সুন্দরবন সংলগ্ন কটকা, কচিখালী, সুপতি, দুবলা, নারকেলবাড়িয়া এলাকায় রয়েছে বলে জেলেদের সূত্রে জানা গেছে।
সোমবার সকাল থেকে বাগেরহাটের দড়াটানা নদীর তীরে মাছ বিক্রির আড়ত কেবি বাজারে নিখোঁজ জেলেদের স্বজনেরা ভিড় করেছেন। মা ছেলের জন্য, স্ত্রী স্বামীর জন্য, সন্তনানের বাবার জন্য অপেক্ষা করে আছেন। সামনে কোববানির ঈদ তাই অনেক জেলে সাগরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। সোমবার তাদের প্রায় সকলের বাগেরহাট কেবি মাছ বাজারে ট্রলার নিয়ে ফিরে আসার কথা। কিন্ত এদিন সকালে এ মৎস্য আড়তে ৪/৫টি ট্রলার ফিরেছে।
কেবি বাজারের ঘাটে কথা হয় বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার বগা এলাকার মাছ ব্যবসায়ী ও নিখোঁজ এফবি শাহজালাল ট্রলারের মালিক হানিফ ব্যপারীর সাথে। তিনি বলেন, তার মেঝ ভাই আবুল ব্যপারীর এফবি সজল ও মামা আবুল বাওয়ালীর এফবি রুপক ট্রলারের এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাদের তিনটি ট্রলার ডুবে গেছে, না কোথাও আশ্রয় নিয়েছে– তার কোনো খবর তিনি এখন পাননি। তিনটি ট্রলারে থাকা তার ভাই মামাসহ ৪২ জনের কারো সাথেই এখন পর্যন্ত যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ঝড়ের কবল থেকে বেঁচে আসা এফবি মামা ভাগ্নে ট্রলারের মাঝি শহিদ মোল্লা জানান, ঝড়ের সময়ে ঢেউয়ের তোড়ে ট্রলারে ইঞ্জিনের দরজা ভেঙে তিনি ও ইমারত আলী সাগরে পড়ে যান। পরে ট্রলার থেকে রশি ফেলে অনেক কষ্টে তারা ট্রলারে উঠতে সক্ষম হন। শহিদ মোল্লা জানান, সাগরে অসংখ্য ট্রলার ভাসতে দেখেছেন।
কথা হয় বাগেরহাট শহরের ট্রলার ব্যবসায়ী মো. মনিরুজ্জামানের সাথে। তিনি বলেন তার দুটি ট্রলারের মধ্যে একটি মামা ভাগ্নের ১৩ জন স্টাফ সোমবার সকালে কোনোমতে ফিরে এসেছে। অপরটি এফবি মদিনার এখনো সন্ধান পাননি।
কেবি বাজারের দড়াটানা নদীর পাড়ে প্রহর গুণছেন এক বৃদ্ধা মা তার সন্তানের জন্য। সাথেই রয়েছে তার পুত্রবধূ রিমা বেগম (২১)। আড়াই বছরের সন্তান তামিম মোল্লাকে নিয়ে অপেক্ষা করছেন তারা। রিমার স্বামী এনামুল মোল্লা সাগরে গেছে মাছ ধরতে। তিনি আবুল বাওয়ালীর ট্রলারে গত তিন বছর ধরে কাজ করছেন। সামনে ঈদ তাই আট দিন আগে চিতলমারী থেকে এসে মাছ ধরার জন্য আবুল বাওয়ালীর ট্রলারে করে সাগরে যান। সোমবার সকাল পর্যন্ত এনামুল মোল্লার কোনো খোঁজ পাননি তারা। রোববার বিকাল থেকে তারা ট্রলার ঘাটে অপেক্ষা করে আছেন।
সোমবার সকালে বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নারায়ণ চন্দ্র মন্ডল কেবি বাজার মৎস্য আড়তে গিয়ে নিখোঁজ ট্রলার ও জেলেদের বিষয়ে খোঁজখবর নেন। তিনি বলেন, নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড শতাধিক জেলেকে সাগরে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করে নিরাপদে নিয়েছে। সোমবার সকাল পর্যন্ত বাগেরহাট, কচুয়া ও শরনখোলার সাতটি ট্রলার ডুবি এবং ২৭ জন নিখোঁজ রয়েছে বলে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের মাধ্যমে উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে নিখোঁজদের অনেকেই থাকতে পারেন বলে তিনি ধারণা করছেন। এখনো কারো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এ বিষয়ে সোমবার দুপুরে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সকল উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নিখোঁজ জেলেদের বিষয়ে খোঁজ নিতে বলা হয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এ্যাড. মীর শওকাত আলী বাদশা ট্রলারডুবি ও জেলে নিখোজের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বনবিভাগ ও স্থানীয় জেলেদের উদ্যোগে সমন্বিত উদ্ধার অভিযান চলছে।