এম. সুরুজ্জামান, শেরপুর: নালিতাবাড়ী উপজেলার মধুটিলা ইকোপার্কে ছাত্রীকে ছুরি দেখিয়ে বিবস্ত্র করে যৌন নিপীড়ন এবং মোবাইলে ওই ঘটনার ছবি তুলে ছড়ানোর দায়ের করা মামলার ১৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আজ (৬ অক্টোবর) বিকেলে শেরপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. বুলবুল আহমেদ, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জিনিয়া জাহান ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নালিতাবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক মো. আরিফ হোসাইন সাক্ষী দেন।
শেরপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট গোলাম কিবরিয়া বুলু বলেন, চাঞ্চল্যকর এ মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আশা করছি আগামী ১৯ অক্টোবর যুক্তি-তর্ক শেষে এ মাসেই মামলার রায় ঘোষণা করা হবে।
২০১৪ সালের ১৭ জুলাই উপজেলার মরিচপুরান ইউনিয়নের একটি গ্রামের বাসিন্দা মাদ্রাসার ডিগ্রি ক্লাসের ছাত্রীকে তার সদ্য বিবাহিত স্বামী বুলবুল কেনাকাটা করার কথা বলে নালিতাবাড়ী শহরে যেতে বলে। সেখান থেকে বুলবুল মোটরসাইকেলে করে ওই ছাত্রীকে মধুটিলা ইকোপার্কে বেড়াতে নিয়ে যায়।
ইকোপার্কের প্রধান ফটকের ইজারাদার প্রতিনিধি স্থানীয় পশ্চিম সমশ্চুড়া গ্রামের মোস্তফা কামালের কাছে মোটরসাইকেল রেখে স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে ওয়াচ টাওয়ারের মাঝামাঝি স্থানে বসে গল্প করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর সমশ্চুড়া গ্রামের শফিকুল ইসলাম (২৭), একই গ্রামের আঃ ছালাম (২৫) ও মনু মিয়া (২৬) ওইস্থানে গিয়ে স্বামীর কাছ থেকে মেয়েটিকে টেনে-হিঁচড়ে পাহাড়ি জঙ্গলে নিয়ে যায়।
এসময় ফিল্মি কায়দায় তিন বখাটে ছুরি দেখিয়ে স্বামীর সামনেই মেয়েটিকে বিবস্ত্র করে মোবাইলে ছবি তোলার পাশাপাশি যৌন নির্যাতন চালাতে থাকে। স্ত্রী নিজেকে বাঁচানোর জন্য মেয়েটি স্বামীকে জাপটে ধরে। কিন্তু স্বামী বখাটের হাতে স্ত্রীকে সোপর্দ করে তাদের সব আবদার মেনে নেয়। এক পর্যায়ে সম্ভ্রম বাঁচাতে মেয়েটি টিলা থেকে নিচে ঝাঁপ দিয়ে চিৎকার করলে এক বৃদ্ধ এসে তাকে উদ্ধার করে বন বিভাগের রেঞ্জ অফিসে পৌঁছে দেন। ঘটনা জানাজানি হলে তিন বখাটে কেটে পড়ে। পরে স্বামী ওই স্ত্রীকে নালিতাবাড়ী শহরে রেখে বাড়ি চলে যায়। সে এ ঘটনা কাউকে না জানানোর নির্দেশও দেয় স্বামী।
পরদিন বখাটে শফিকুল তার সহযোগী মোস্তফা কামালকে ব্লুটুথের মাধ্যমে মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিওটি ফরোয়ার্ড করে। তাদের সহযোগী লিটন ভিডিওটি নিয়ে ২১ জুলাই ওই ছাত্রীর বাড়ি যায় এবং তার বোন মাকছুদা বেগমের কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে ভিডিওটি ছড়িয়ে দিবে বলে হুমকি দেয় লিটন।
এ সময় লজ্জা ও ভয়ে মেয়েটি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানায়। পরে নালিতাবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক মো. আরিফ হোসাইনকে মেয়েটির ভাই ঘটনাটি খুলে বলে। অনেক বুঝিয়ে শান্ত করার পর ১৩ আগস্ট থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন ভিকটিম। তদন্ত শেষে পুলিশ ওই ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে দু’টি পৃথক মামলা গ্রহণ করে।
মামলা দায়েরের দু’দিন পর স্থানীয় এমপি ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী দেশে ফিরে এসে ঘটনাটি জেনে ২৪ ঘন্টার মধ্যে বখাটেদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিলে ঝিনাইগাতী উপজেলা থেকে শফিকুলকে গ্রেফতার করা হয়। আদালতে ১৬৪ ধারায় শফিকুল ঘটনার সাথে মোস্তফা, মনু, সালাম, লিটন ও মেয়েটির স্বামী বুলবুল জড়িত রয়েছে বলে জবানবন্দি দেয়। পরে তার দেওয়া তথ্যে আলামত উদ্ধার করে মোস্তফা, মনু ও বুলবুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সালাম আত্মসমর্পণ করলে আদালত তার জামিন আবেদন নাকচ করে দেন। ঘটনার পর থেকে নাজমুল হাসান লিটন পলাতক রয়েছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি নজরুল ইসলাম বুলবুলের বাবা মারা গেলে আদালত তাকে শর্তসাপেক্ষে তিনদিনের জামিন দেয়। কিন্তু জানাজায় অংশ নেওয়ার পর তিনি আদালতে হাজির না হয়ে পালিয়ে যান।
যৌন নিপীড়নের ঘটনায় ৩২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তদন্ত শেষ করে পুলিশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় ওই পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে ২৪ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করলে শেরপুর নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাইদুর রহমান খাঁন অভিযোগপত্র গ্রহণ করে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করেন। পর্নোগ্রাফির মামলায় আসামি পলাতক থাকায় বিচারের প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার মেহেদুল করিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অভিযোগ দায়েরের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অভিযান চালিয়ে আসামিদের গ্রেফতার করে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যে আলামত হিসেবে ভিডিও ক্লিপ উদ্ধার করা হয়। বাদী ও সাক্ষী জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যথাসময়ে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। বিচারপ্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। সাক্ষ্য ও আলামত পর্যালোচনায় প্রাথমিকভাবে ঘটনার সাথে আসামিদের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়েছে বলে জানান তিনি।