শিক্ষার জন্য অভাবী দুই বোনের অদম্য সংগ্রাম

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া(পটুয়াখালী): একটু পরই দ্বিতিয় শ্রেণির ছাত্রী ইমা’র পরীক্ষা। কিন্তু বাবা ঘর থেকে না বেরোলে দুপুরে না খেয়েই থাকতে হবে। তাই স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই হুইল চেয়ার ঠেলে বাবা দুলাল হাওলাদারকে (৪০) নিয়ে ভিক্ষায় নামলো সে। বাবাকে খেয়া ঘাটে রেখে সে যাবে পরীক্ষা দিতে। এ খেয়াঘাটে অন্যের সহায়তায় চলে তাঁদের সংসার।

????????????????????????????????????
হুইল চেয়ারে বসা বাবাকে ভিক্ষার জন্য রেখে ইমা স্কুলে যায়

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লোন্দা আবাসন প্রকল্পের একটি ঘরে দুই মেয়ে মীম, ইমা, ছেলে রাহাত ও স্ত্রী মর্জিনাকে নিয়ে দুলাল হাওলাদারের সংসার। শ্রমজীবী এ মানুষটি সাত বছর আগেও কঠোর পরিশ্রম করে সংসার চালাতেন। কিন্তু ২০০৯ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার দুটি পা ভেঙ্গে যাওয়ায় এখন হুইল চেয়ারে করেই ভিক্ষাবৃত্তি করে চালাতে হচ্ছে সংসার। এখন তার একটাই স্বপ্ন দুই মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা।

মধ্য টিয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ইমা জন্ম থেকেই দেখছেন পিতার এ অসহায়ত্ব। স্কুলে তার বয়সী মেয়েরা যখন নতুন জামা, নতুন স্কুল ড্রেস কিংবা নতুন খেলনা নিয়ে সহপাঠীদের সাথে খেলা করে তখন এককোনে বসে ইমা তা শুধু উপভোগ করে। বাবা ভিক্ষা করে তাই স্কুল ড্রেসটি ছোট হয়ে গেলেও নতুন শিক্ষাবর্ষের চারমাস অতিবাহিত হলেও তা বানানো হয়নি।

গতকাল সকালে স্কুলের সামনে বসে কথা হয় ইমার সাথে। ইমার ভাষায় “আব্বায় যা দ্যায় হ্যাতেই আমি খুশি। মোর আব্বায় হগলডির মতো ভারি কাজ করতে পারে না। ভিক্ষা কইর‌্যা আমাগো খাওয়ায়। আমরা অন্য পোলাপানের মতো চলমু ক্যামনে”।

এই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ইমার বড় বোন মীম (রোল নং ৩)। মেধাবী এই ছাত্রীরও একই অবস্থা। নেই খাতা-কলম। শেষ কবে গায়ে নতুন জামা দিয়েছেন তা বলতেও পারছেন না। তবে পিতার অসহায়ত্ব তাদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই দুই বোন পড়তে চায়, বড় হয়ে পড়াতে চায় তাদের মতো অসহায়দের। তাই পেটে ভাত, কিংবা গায়ে নতুন জামা না থাকলেও ওরা লেখাপড়া করতে চায়।

ইমা ও মীমের সহপাঠীরা বলেন, লেখাপড়ায় অরা দুই বোনই ভালো। অগো বাবার পায়ে সমস্যা। হেইয়ার লাইগ্যা অরা মনমড়া থাকলেও অগো স্কুলে আওয়া বন্ধ হয়না। আর সবাই অগো ভালো পায়।

দুলাল হাওলাদার বলেন, বড় পোলাডারে পড়াইতে পারি নাই। দূরে যহন ভিক্ষা করতে যাই তহন আমারে ও ঠেইল্লা লইয়া যায়। রোজ ৭০-৮০ টাহা পাই। হেইয়া দিয়া তেনডা পোলা-মাইয়ার মুহে দুইডা ভাত দেতে পারলেও বেশির ভাগ সময়ই টোহাইন্না শাক দিয়া ভাত খাওন ছাড়া মাছ-মাংস কেনতে পারিনা। কিন্তু আমার তো ভিক্ষা ছাড়া কোন উপায় নাই, হেইয়ার মধ্যেও মাইয়া দুইডা খুব ব্রেনি (মেধাবী) দেইখ্যা স্কুলে পাডাই। কিন্তু অগো ঠিকমতো বই-খাতা,কলম কিইন্না দিতে পারি না। মাইয়া মানু দেইখ্যা অনেকে পুরান জামাকাপুড় দেয়। হেইয়াই গায় দ্যায়।

তিনি বলেন, মুই যদি একখানে বইয়া একটু দোহান করতে পারতাম তাইলে হয়তো পোলাডায় কিছু করতে পারতো। কিন্তু মোর তো টাহা নাই ক্যামনে দোহান দিমু। হেইয়ার লাইগ্যা পোলাই মোর ভিক্ষার সঙ্গী। মাঝে মাঝে মাইয়ারাও মোরে ঠেইল্লা নেয়। ঘরে বইয়া থাকলে তো খাওন জোডে না। এ্যাহন মাইয়া দুইডারে ল্যাহাপড়া করানোই মোর স্বপ্ন। দেহি আল্লায় কদ্দুর নেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.