ইদিলপুর: ফলের বাণিজ্যিক চাষের অনন্য মডেল

আব্দুল্লাহ আবু  এহসান, মধুপুর (টাঙ্গাইল)


লালমাটির উঁচু-নিচু টিলা নিয়ে গড়া ইদিলপুর গ্রামটির অবস্থান মধুপুর উপজেলা সদর থেকে নয় কিলোমিটার দূরে। গ্রামজুড়ে আনারস, কলা, আম, কাঁঠাল, পেঁপে আর লিচু বাগান। গ্রামের আদিবাসী গারো আর বাঙালিরা প্রায় ৭৫ বছর ধরে ফলের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। ফল উৎপাদনের ঐতিহ্যের জন্য এ গ্রামটি পরিচিতি পেয়েছে ফলের গ্রাম হিসেবে।
সুলতানি আমলে আদিবাসী গারোরা জঙ্গল সাফ করে এখানে বসতি স্থাপন করে। তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন ছিল জুম চাষ। ব্রিটিশ আমলে এখানে বাঙালি বসতি গড়ে উঠে। জুমের জমিতে বাঙ্গি, বিচিকলা, কার্পাস তুলা, বনআলু আর ক্ষিরা ফলাতো গারোরা। ১৯৫০ এর দশকে সরকার জুম চাষ নিষিদ্ধ করলে এ গ্রামে কৃষিতে পরিবর্তন সূচিত হয়। আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা, পেঁপে, বরই, লিচু ইত্যাদির চাষ শুরু হয় এখানে। ক্রমে ক্রমে তা বাণিজ্যিক কৃষির রূপ নেয়।

চালানের জন্য প্রস্তুত আনারসের স্তূপ।
চালানের জন্য প্রস্তুত আনারসের স্তূপ।

ইদিলপুরে প্রায় তিন হাজার মানুষের বাস। বাসিন্দাদের এক-তৃতীয়াংশ গারো। তাদের হাতেই এখানে আনারস চাষের যাত্রা শুরু যা পরে পুরো মধুপুর গড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে  মধুপুর গড়ের মধুপুর, মুক্তাগাছা, জামালপুর সদর (আংশিক), ফুলবাড়িয়া, ঘাটাইল ও ভালুকা উপজেলার প্রায় ২৮ হাজার একরে আনারস চাষ হয়।

ইদিলপুরে আনারসের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যোগ হয় লিচু, কলা, বরই আর পেঁপে। ধীরে ধীরে ফল চাষ বিস্তৃত হয়েছে ২ হাজার ৬০০ একর জমিতে। সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে আনারস, লিচু এবং কলার। প্রতিবছর এ গ্রামে ৪০ থেকে ৪৫ কোটি টাকার ফল উৎপাদন হয় বলে জানান ইদিলপুর আনারস চাষি সমবায় সমিতির সাবেক সম্পাদক আলী আকবর ফকির। সমিতির সভাপতি মফিজ উদ্দীন ফকির জানান, এ গ্রামে এখন কোনো অভাবী মানুষ নেই। গ্রামের ৯৮ ভাগ মানুষ শুধু ফলের আবাদ করে অভাব ঘুচিয়েছে। গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মালেক জানান, সারা বছরই এ গ্রামে ফল পাওয়া যায়। তবে মে হতে ডিসেম্বর ফলের ভরা মৌসুম। এ সময় সারা গ্রাম জুড়ে ফলের থাকে মিষ্টি গন্ধ। এ সময় গ্রামের মেয়েরা বাপের বাড়িতে নাইয়র আসে। গ্রামের বিয়েশাদিসহ নানা অনুষ্ঠান এ সময়েই অনুষ্ঠিত হয়।

গ্রামের বিপিন সাংমা ও আজগর মন্ডল গত ৫৫ বছর ধরে,  মোকছেদ মন্ডল ৫২ বছর এবং নিভারানী রিছিল ৫০ বছর ধরে আনারস চাষ করেন। ফল চাষে তাদের জ্ঞান বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের। আনারস চাষে তাদের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা বিস্ময়কর বলে জানান স্থানীয় কৃষিবিদরা।

গ্রামের চাষিরা এক সময় আনারস চাষের জন্য মহাজনি ঋণের দ্বারস্থ হতো। এখন অবশ্য চিত্র পাল্টে গেছে। ১৯৭৭ সালে প্রয়াত স্কুলশিক্ষক আব্দুল হালিম মাস্টারের উদ্যোগে গড়ে উঠে ইদিলপুর আনারস চাষি সমবায় সমিতি। এ সমিতি আনারসচাষিদের সামনে চলার সাহস ও সমর্থন জুগিয়েছে। এ সমিতির নিজস্ব ভবন রয়েছে। সমিতির বর্তমান মূলধন  প্রায়  আড়াই কোটি টাকা। প্রয়োজনের সময় চাষিরা এখান থেকেই ঋণ গ্রহণ করেন। ফল চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখায় ইদিলপুর আনারস চাষি সমবায় সমিতি জাতীয় পর্যায়ে দুইবার স্বর্ণপদক লাভ করে।

ফলচাষি বীরেন দিও জানান, এ গ্রামে একটি হাইস্কুল, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাদ্রাসা, দুটি মিশনারি স্কুল এবং অনাথ শিশু পল্লী রয়েছে।  আর এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ফলচাষিদের উদ্যোগ। বর্তমানে এ গ্রামে শিক্ষার হার ৮০ শতাংশ। আইনজীবী রফিকুল ইসলাম এ গ্রামের বাসিন্দা। তিনি জানান, ফলের আবাদে এ গ্রামের লোকেরা একটি সুদীর্ঘ ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছেন। অভাব-অনটন বিদায়ের পর এবার ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সমিতির সকলে মিলেমিশে কাজ করছেন। সমিতির সম্পাদক আলী আকবর ফকির জানান, ইদিলপুর গ্রাম থেকেই আনারস চাষ শুরু। এ জন্য এ গ্রামের লোকেরা গর্ব অনুভব করে। কিন্তু সম্প্রতি এক শ্রেণীর মুনাফালোভী মহাজন-ব্যবস্যয়ীরা নিষিদ্ধ ও ক্ষতিকর হরমোন দিয়ে আনারসসহ সকল প্রকার ফল পাকানোর রেওয়াজ শুরু  হওয়ায় প্রকৃত চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ইদিলপুর গ্রামের আনারসচাষিরা হরমোন দিয়ে ফল পাকানোর প্রযুক্তি বন্ধের জন্য আন্দোলন করে আসছেন। স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একাধিকবার অনুরোধ করেছেন কিন্তু বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি (যারা বৈধ-অবৈধ পথে হরমোন বাজারজাত করছে) এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দাপটে প্রশাসন এ প্রক্রিয়া উচ্ছেদে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আরো জানান, ফল চাষের পাশাপাশি ইদিলপুর গ্রাম হলো হাজারো বৃক্ষ আর গুল্মলতায় সুশোভিত গ্রামীণ বন। আবাসস্থল ও খাদ্যের সমাহার থাকায় নানা জাতের পশু-পাখি এ গ্রামে নিরাপদ আবাস গড়ে তুলেছে। আজগর আলী মন্ডল বলেন, ফল-ফলাদিকে  গ্রামের লোকেরা  লক্ষ্মী  মনে করে।  ফল এ গ্রামের নিরন্ন মানুষের ভাগ্য ফিরিয়েছে। দরিদ্রতার অবসান ঘটিয়েছে। বিত্তহীন মানুষের মধ্যে সুখ-স্বচ্ছন্দ্য এনেছে। একটানা পৌনে এক শতাব্দী ধরে কোনো জনপদের মানুষ শুধু মাত্র ফল চাষ করে জীবিকা  নির্বাহ করে এমন উদাহরণ শুধুমাত্র ইদিলপুর গ্রাম ছাড়া দেশের আর কোথাও নেই বলে দাবি করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.