ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর জীবনী

ড. মুহাম্মদ ইউনূস (জন্ম: ২৮ জুন, ১৯৪০) বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, সামজিক উদ্দোক্তা, সমাজসেবক ও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। তিনি ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষুদ্রঋণ ও ক্ষুদ্রবিত্ত ধারণার প্রবর্তনের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।

ড.ইউনুস বেশ কয়েকটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মাননা। তিনি প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পান, পরে ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম এবং ২০১০ সালে কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পান।
ড.ইউনুস হলেন বিশ্বের মাত্র সাতজন ব্যক্তির একজন, যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পেয়েছেন। ২০২০ সালে তিনি ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি থেকে একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেন।

২০১১ সালে ফেব্রুয়ারিতে ড.ইউনুস সাস্কিয়া ব্রুইস্টেন, সোফি আইজেনম্যান এবং হ্যান্স রাইটজের সাথে একত্রে ইউনুস সামাজিক ব্যবসা – গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভস প্রতিষ্ঠা করেন। ইউনুস সামাজিক ব্যবসা সারা বিশ্বে সামাজিক সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য সামাজিক ব্যবসা তৈরি ও ক্ষমতায়িত করে।
ড.ইউনুসের নতুন, মানবিক পুঁজিবাদের দৃষ্টিভঙ্গির আন্তর্জাতিক বাস্তবায়ন শাখা হিসেবে এই সামাজিক ব্যবসা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সামাজিক ব্যবসার জন্য ইনকিউবেটর তহবিল পরিচালনা করে এবং কোম্পানি, সরকার, ফাউন্ডেশন এবং এনজিওদের পরামর্শ সেবা প্রদান করে।
ড.ইউনুস ২০১২ সালে তিনি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হন এবং এই পদে তিনি ২০১৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

এর আগে তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি তার অর্থনৈতিক কাজের উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ করেছেন। তিনি গ্রামীণ আমেরিকা এবং গ্রামীণ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা বোর্ড সদস্য, যা ক্ষুদ্রঋণকে সমর্থন করে।
ইউনুস ১৯৯৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের কার্যক্রমকে সমর্থনকারী জনহিতকর সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদে দায়িত্ব পালন করেন।
পরিবার এবং শৈশব

মুহাম্মদ ইউনুস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রামের হাটহাজারির কাপ্তাই সড়কের বাথুয়া গ্রামে একটি বাঙালি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তাঁর পিতা হাজী দুলা মিয়া সওদাগর ছিলেন একজন জহুরি, এবং তাঁর মাতা সুফিয়া খাতুন। তার শৈশব কাটে গ্রামে। ১৯৪৪ সালে তার পরিবার চট্টগ্রাম শহরে চলে আসে এবং তিনি তার গ্রামের স্কুল থেকে লামাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলে যান।

তিনি ১৯৪৯ সালের দিকে তার মা মানসিক অসুস্থতায় ভুগতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং পূর্ব পাকিস্তানের ৩৯ হাজার ছাত্রের মধ্যে ১৬তম স্থান অধিকার করেন।
বিদ্যালয় জীবনে তিনি একজন সক্রিয় বয় স্কাউট ছিলেন এবং ১৯৫২ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারত এবং ১৯৫৫ সালে কানাডায় জাম্বোরিতে অংশগ্রহণ করেন। পরে, যখন ইউনুস চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা করছিলেন, তখন তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হন এবং নাটকের জন্য পুরস্কার জিতেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে বিএ এবং ১৯৬১ সালে এমএ সম্পন্ন করেন।

স্নাতক শেষ করার পর তিনি নুরুল ইসলাম এবং রেহমান সোবহানের অর্থনৈতিক গবেষণায় গবেষণা সহকারী হিসেবে অর্থনীতি ব্যুরোতে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। একই সময়ে তিনি পাশাপাশি একটি লাভজনক প্যাকেজিং কারখানা স্থাপন করেন।১৯৬৫ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য ফুলব্রাইট স্কলারশিপ লাভ করেন। ১৯৭১ সালে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ইন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (GPED) থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ড.ইউনূস ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত, মার্ফ্রিসবোরোতে মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক ছিলেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি একটি নাগরিক কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং অন্যান্য বাংলাদেশিদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সমর্থন সংগ্রহ করতে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার পরিচালনা করেন। তিনি ন্যাশভিলের তার বাড়ি থেকে ‘বাংলাদেশ নিউজলেটারও’ প্রকাশ করতেন। যুদ্ধ শেষ হলে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে নিযুক্ত হন। তবে কাজটি তার কাছে একঘেয়ে লাগায় তিনি সেখানে ইস্তফা দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন।

ইউনুস দারিদ্র্যতার বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম শুরু করেন ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত দুর্ভিক্ষের সময়। তিনি বুঝতে পারেন স্বল্প পরিমাণে ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবন মান উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে। সেই সময়ে তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে মুহাম্মদ ইউনুস তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে। প্রকল্পটিকে আরও কার্যকর করতে ইউনুস এবং তার সহযোগীরা ‘গ্রাম সরকার’ কর্মসূচি প্রস্তাব করেন। যেটি ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রবর্তন করেন। এই কর্মসূচির অধীনে সরকার ২০০৩ সালে ৪০,৩৯২টি গ্রাম সরকার গঠিত হয়, যা চতুর্থ স্তরের সরকার হিসাবে কাজ করত। তবে ২০০৫ সালের ২ আগস্ট বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) কর্তৃক দায়ের করা একটি পিটিশনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গ্রাম সরকারকে অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করে।

বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে উদ্ভাবকদের সহায়তার জন্য ইউনুসের ক্ষুদ্রঋণ ধারণা ‘ইনফো লেডি সোশ্যাল এন্টারপ্রেনারশিপ’ প্রোগ্রামের মতো কর্মসূচিকে অনুপ্রাণিত করে।

১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি জোবরা গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সময় ইউনুস আবিষ্কার করেন যে খুব ছোট ঋণ দরিদ্র মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য তৈরি করতে পারে। গ্রামের মহিলারা যারা বাঁশের আসবাব তৈরি করতেন, তাদের বাঁশ কিনতে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হতো এবং তাদের লাভ ঋণদাতাদেরকে দিতে হতো। প্রথাগত ব্যাংকগুলো দরিদ্রদেরকে উচ্চ ঋণখেলাপির ঝুঁকির কারণে যুক্তিসঙ্গত সুদে ছোট ঋণ দিতে চায়নি।

কিন্তু ইউনুস বিশ্বাস করতেন যে, সুযোগ পেলে দরিদ্ররা উচ্চ সুদ পরিশোধ করতে হবে না, তাদের নিজেদের পরিশ্রমের লাভ রাখতে পারবে, সেজন্য ক্ষুদ্রঋণ একটি কার্যকর ব্যবসায়িক মডেল হতে পারে। ইউনুস তার নিজের টাকা থেকে ২৭ মার্কিন ডলার ঋণ দেন গ্রামের ৪২ জন মহিলাকে, যারা প্রতি ঋণে ০.৫০ টাকা (০.০২ মার্কিন ডলার) লাভ করেন। যেজন্য ইউনুসকে ক্ষুদ্রঋণের ধারণার জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয়।

মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান

মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে এই পুরস্কার লাভ করেন।ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ২০০৯ সালের বার্ষিক সভায় ড. ইউনূস বক্তব্য রাখছেন, দাভোস, সুইজারল্যান্ড
ডঃ ইউনুস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬২টি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.