আমিনা বিলকিস ময়না, সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরা মিল্ক ভিটার দুর্নীতিবাজ কর্মীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে খামারিসহ দুধ উৎপাদন ও বাজারজাতের সঙ্গে যুক্ত ১০ হাজারের বেশি মানুষ।
সাতক্ষীরা দুগ্ধ শীতলকরণ কেন্দ্রের আওতায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে ২৬টি দুগ্ধ সমবায় সমিতি রয়েছে। কিন্তু এ কেন্দ্রের ল্যাব টেকনিশিয়ান ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সরবরাহকৃত দুধে ফ্যাটের পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য পুরনো পদ্ধতি অনুসরণ করে ফ্যাটের পরিমাণ কমিয়ে দেখান। ফলে নিরূপায় হয়ে স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে কম দামে দুধ বেচে দিতে হয় সরবরাহকারীদের। অন্যদিকে, কাগজপত্রে ফ্যাটের পরিমাণ স্বাভাবিক বা বাড়িয়ে দেখিয়ে ফায়দা নেন এসব কর্মীরা।
ফ্যাট জালিয়াতির কারণে সমিতিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, পাশাপাশি ক্ষুদ্র খামারিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর ফ্যাট কারসাজি করে বিশাল অংকের টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন ওই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে তারা নিজেদের সরবরাহকারী শ্রেণীও তৈরি করে নিয়েছেন। তাদের সরবরাহকৃত দুধে ফ্যাট বাড়িয়ে দেখানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এই কারসাজিরও ফায়দা নিচ্ছেন মিল্ক ভিটার দুর্নীতিবাজ কর্মীরা।
২০০৫ সালের সাতক্ষীরা বিসিক শিল্প নগরীতে মিল্ক ভিটার দুগ্ধ শীতলকরণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর এখানে ৩০টি সমবায় সমিতি নিবন্ধিত হয়ে নিয়মিত দুধ সরবরাহ করত। এই কেন্দ্রের ধারণক্ষমতা সাড়ে ১০ হাজার লিটার। যেখানে প্রতিদিন গড়ে ছয় হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করা হয়।
সূত্র জানায়, এ কেন্দ্রে সক্রিয় ২৬টি সমিতির আট শতাধিক ব্যক্তি নিয়মিত দুধ সরবরাহ করে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা ও বিকাল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সমিতির মাধ্যমে দুধ গ্রহণ করা হয়।
সূত্র আরো জানায়, মিল্ক ভিটার নিয়ম অনুযায়ী দুধে ফ্যাটের স্বাভাবিক পরিমাণ হলো চার পয়েন্ট যার ভিত্তিতে দুধের দাম নির্ধারণ করা হয়। এটা মাপার জন্য ডিজিটাল মিল্ক এ্যানালাইজারের ব্যবহার আছে। কিন্তু এ কেন্দ্রের ল্যাব টেকনিশিয়ান মুস্তাইন বিল্লাল সুপারিশকৃত নিয়ম না মেনে সনাতন পদ্ধতিতে দুধে ফ্যাটের শতকরা হার নির্ণয় করেন।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, মুস্তাইন একটি চক্র তৈরি করেছেন। তিনি ফ্যাট কমিয়ে দাম নির্ধারণ করেন। অন্যদিকে তার চক্রের কিছু লোকজনের সাথে চুক্তি করে তাদের দুধে ফ্যাট বেশি দিয়ে কাগজপত্র তৈরি করেন।
দুগ্ধ পেশাজীবী নেতা ও তালা উপজেলার চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার জানান, সমবায়ীদের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন মিল্ক ভিটার সাতক্ষীরা শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হামিদুল ইসলাম, ল্যাব টেকনিশিয়ান মুস্তাইন বিল্লাহ ও সহকারী টেকনিশিয়ান রাসেল আহমেদ প্রকৃত সমবায়ীদের উপেক্ষা করে একটি চক্র তৈরি করেছেন। হামিদ, বিল্লাহ ও রাসেল সমবায়ীদের দুধ বিক্রির সময় নানা কৌশলে ঘুষ দাবি করেন। যে সমবায়ীরা ঘুষ দিতে চায় না তাদের দুধে ননি বা ফ্যাট কম আছে জানিয়ে দুধ অবিক্রিত রেখে ক্ষতি সাধন করেন। এই ঘুষ চক্রের প্রতিবাদকারীদের ঠেকানোর জন্য আবার পাল্টা সমবায়ীও প্রস্তুত করা হয়েছে।
বিষয়টি জানতে পেরে উপজেলা চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (যুগ্ম সচিব) জহিরউদ্দিন বাবরকে ফোনে বিষয়টি বারবার অবগত করেন। বিষয়টি দেখভালের জন্য ঢাকা ডেইরি থেকে নভেম্বরের ২২ তারিখে সাবদুল ইসলাম নামের এক কর্মীকে সাতক্ষীরায় পাঠানো হয়। সাবদুল আসার পর সাতক্ষীরার দুগ্ধ সমবায়ীদের দুধের মান স্বাভাবিক প্রমাণিত হতে থাকে।
কিন্তু ক্ষমতাবান চক্রটি এক মাসের মধ্যে (১৫ ডিসেম্বর ২০১৫) উপরে দেনদরবার করে সাবদুলকে নরসিংদীতে বদলি করে ফেলতে সক্ষম হয়। দুগ্ধ সমবায়ীর ফের জিম্মি হয়ে পড়ে চক্রটির কাছে।
এর আগে হামিদ, বিল্লাহ ও রাসেল চক্রের অনিয়ম ধরে ফেলায় হিসাবরক্ষক ইব্রাহিমকে বদলি করে ঝিকরগাছায়, সমিতি সংগঠক মাহবুবুর রহমানকে বদলি করে বাঘাবাড়ি পাঠানো হয়।
তালা দুগ্ধ সমবায় ঐক্য পরিষদের সভাপতি রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, অনিয়মের প্রতিবাদ করলেই দুর্ব্যবহার ও হুমকি দিয়ে সাতক্ষীরার দুগ্ধ শিল্প চিরতরে ধ্বংস করে দেয়ার হুমকি দিয়ে থাকেন হামিদ বিল্লাহ চক্রটি।
সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনের সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লাহ জানান, সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী ও প্রতিষ্ঠিত দুগ্ধ শিল্প সম্পর্কে দেশবাসী অবগত। দুর্নীতিবাজদের জন্য এ শিল্প ধ্বংস হলে হাজার হাজার দুগ্ধসমবায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তিনি দুর্নীতি বন্ধ করে সমবায়ীদের সুরক্ষার আশ্বাস দেন।
উল্লেখ্য, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হামিদুল ইসলাম খুলনায় চাকরি করার সময় মিল্ক ভিটার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। তদন্ত কর্মকর্তা মিল্ক ভিটার ডিজিএম বিদ্যুৎ কুমার মন্ডলের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন।
সমবায়ীরা বলেন, হামিদ-বিল্লাহ চক্রের হাত অনেক শক্তিশালী। এদের অপসারণের দাবিতে মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিষয়টি অবগত হয়েই এজিএম প্রশাসন আবুল বাশারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছেন।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা কেন্দ্রের ল্যাব টেকনিশিয়ান বিল্লাহ বলেন, যারা সুবিধা পায় না তারা এ অভিযোগ করছে। কিন্তু অভিযোগের বিষয় সঠিক নয়। কেন্দ্রে কর্মরত ডাক্তার আশরাফুজ্জামান জানান, ল্যাব টেকনিশিয়ান সঠিকভাবে কাজটি করেন। যারা অভিযোগ করেছে তাদের অভিযোগ সঠিক নয়।
কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হামিদুল ইসলামকে বুধবার বেলা ১২টায় গিয়ে অফিসে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে বার বার কল দিলেও রিসিভ করেননি।